দুই ঋতুর দেশ সৌদি আরবের খেজুর বাংলাদেশের মাটিতে চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামের কৃষক মো. আব্দুল মোতালেব (৬০)। বর্তমানে ১৪ বিঘা জমির ৪টি বাগান থেকে বছরে তার আয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা। দীর্ঘ শ্রম আর কঠোর আত্মবিশ্বাস তাকে এনে দিয়েছে এই সফলতা। সৌদির খেজুর চাষ করে তিনি এখন দেশের ‘আইডল কৃষক’।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মোতালেবের বাড়ির পাশেই বাউন্ডারি বেষ্টিত খেজুর বাগান। বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে রকমারি জাতের খেজুর। ছোট গাছের খেজুরের বাঁধা মাটিতে নুইয়ে পড়ছে । আর বড় গাছের খেজুরগুলো ঝুলে আছে থোকায় থোকায়। সেগুলো পাড়তে গাছের সঙ্গে লাগানো রয়েছে লোহার সিঁড়ি আকৃতির মই। এই সিঁড়ি ব্যবহার করেই গাছে উঠে খেজুর নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। মরুভূমির ফল খেজুর বাংলাদেশের মাটিতে এমনভাবে চাষ হতে পারে মোতালেবের বাগান তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।
বাগানের শ্রমিক মো. ফরহাদ মিয়া খেজুরের বাঁধা কাটতে কাটতে বলেন, গত দুই বছর ধরে আমি এই বাগানে কাজ করি। আগে শুনতাম বাংলাদেশের শ্রমিকরা সৌদি আরবে গিয়ে খেজুর বাগানে কাজ করে। কিন্তু আমি দেশেই খেজুর বাজানে কাজ করি, খেজুর মাড়াই করি। ভালোই লাগে।
সে আরও জানায়, প্রতিদিন দূরদুরান্ত থেকে মানুষ আসে এই বাগান দেখতে। আমাদের মালিক তাদের বিনামূল্যে গাছের খেজুর খাইয়ে দেন। দেশের মাটিতে আসল খেজুরের স্বাদে সবাই মুগ্ধ হয়। মানুষ তার বাগান দেখে প্রশংসা করে। অনেকেই নতুন বাগান করতে তার কাছ থেকে চারা নিয়ে যান।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমদিকে মোতালেবের এই খেজুর চাষকে পাগলামি মনে করত এলাকার মানুষ। কিন্তু এখন তার সফলতায় আশপাশের অনেক মানুষ মোতালেবের কাছ থেকে চাষ পদ্ধতি জেনে চারা কিনে নিয়ে বাগান তৈরি করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এসে খেজুরের চারা নিয়ে যায়। তারাও মোতালেবের বাগান দেখে মুগ্ধ।
জানা যায়, লেখাপড়া না করায় সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবে শ্রমিক ভিসায় কাজে গিয়েছিলেন আব্দুল মোতালেব। সেখানে গিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত খেজুর বাগানে কাজ করেন তিনি। তখন মরুভূমিতে বসেই দেশের মাটিতে খেজুর চাষের পরিকল্পনা করেন। এরপর ওই বছরই দেশে ফিরে আসেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে আসেন রকমারি জাতের প্রায় ৩৫ কেজি খেজুর বীজ। এরপর বাড়ির আঙিনায় দুই বিঘা জমিতে রোপণ করেন ২৭৫টি চারা। কিন্তু সেসব গাছে খেজুর হয়নি। এরপর আবার চারা লাগালে আসেনি সফলতা। তবে আত্মবিশ্বাসী মোতালেবের তৃতীয়বারের চেষ্টায় মাত্র দুটি গাছে খেজুর হয়। বর্তমানে মোতালেবের ৭ বিঘা খেজুর বাগানে ৩ হাজারের বেশি সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের খেজুর গাছ রয়েছে।
বাগানের শ্রমিক মো. সুজন মিয়া বলেন, এখানে উৎপাদিত খেজুরগুলো তুলনামূলক বড় ও খেতে সুস্বাদু। স্বাদে-গন্ধে সৌদির খেজুরের মতই। বর্তমানে এই বাগানে খেজুর বিক্রির পাশাপাশি চারা বিক্রি করা হয়। এখানে কাজ করেই পরিবারের ভরণপোষণ চালাচ্ছি।
আব্দুল মোতালেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাগান শুরুর দিকে অনেকেই ঈর্শ্বান্বিত হয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। তখন বনবিভাগের ১৪টি মামলায় আমি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। তবে আইনি লড়াইয়ে একপর্যায়ে সব মামলা শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে আমার ১৪ বিঘা জমিতে ৪টি বাগান। এর মধ্যে ৭ বিঘা জমিতে খেজুর চাষ হয়। এতে প্রায় ৩ হাজারের অধিক গাছে খেজুরের ফলন হয়। আর বাকি ৭ বিঘাতে দেশি ও বিদেশি জাতের মিশ্রণ করে রস উৎপাদনের কাজ করছি। এ বছরই প্রায় ৮ হাজার গাছ থেকে নামানো হবে রস। এ থেকে গুড় উৎপাদন করা হবে। এর মাধ্যমে দেশে চিনি বা গুড়ের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে রস উৎপাদন নিয়ে বেশি কাজ করছে আমার অনার্স পড়ুয়া ছেলে মো. মিজানুর রহমান। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সৌদি আরবে বসে শুনেছিলাম আমার দেশের নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুই ঋতুর মরুভূমির দেশে নিম গাছ লাগিয়েছিলেন। আজও সেই নিম গাছ হাজীদের ছায়া দেয়। তখন আমি মনে মনে চিন্তা করেছি মরুর দেশে যদি নিম গাছ হয়, তাহলে বাংলাদেশে কেন সৌদি আরবের খেজুর হবে না। মূলত এই বিশ্বাস থেকেই সৌদি আরব থেকে বীজ নিয়ে এসে দেশের মাটিতে খেজুর চাষ শুরু করি। এরপর পত্রিকায় আমার বাগানে সৌদি আরবের খেজুর ফলেছে খবর দেখে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৪ সালে ছুটে আসেন। তখন তিনি ৪৫ মিনিট আমার বাগানে অবস্থান করে ঘুরে দেখেন। তার এই আগমন আমাকে এই কাজে আরও বেশি উৎসাহিত করেছিল। আশা করছি তারেক রহমান দেশে ফিরলে আবারও আমার বাগানে আসবেন।
খেজুর চাষে আব্দুল মোতালেবের প্রশংসা করে ভালুকা উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, খেজুর চাষের ক্ষেত্রে পুরুষ ও মাতৃগাছের চারা নির্বাচনে অনেকের সমস্যায় পড়তে হয়। এজন্য সতর্কতার সঙ্গে চারা নির্বাচন করতে হয়। এই কাজটি মোতালেব ভালো জানেন। তাকে দেখে বর্তমানে অনেকেই খেজুর চাষ করছে। আমরা তাদের নিয়মিত পরামর্শ দেই। তবে সরকারিভাবে সুযোগ না থাকায় সরাসরি কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে খেজুরবাগানে আমরা কোনো সহযোগিতা করতে পারি না। যদি খেজুর চাষিদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে চাষিরা উপকৃত হবে।
এদিকে গত ৬ আগস্ট মোতালেবের খেজুর বাগান পরিদর্শন করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি খেজুরবাগানটি দেখতে গিয়েছিলাম, খেজুর খেয়েছি। স্বাদ সৌদির খেজুরের মতোই। বাজারে সৌদির খেজুরের দাম বেশি। তাই মোতালেবের বাগানের চারার মাধ্যমে দেশে পর্যাপ্ত খেজুর বাগান গড়ে উঠলে এবং খেজুর উৎপাদন হলে দেশ উপকৃত হবে। তাই সৌদি খেজুর চাষের সম্প্রসারণ ও প্রণোদনার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে উত্থাপন করা হবে।